-->

ভাষার অবিভাবক -প্রফেসর মনসুর উর রহমান

-প্রফেসর মনসুর উর রহমান


আমরা পারিবারিক  বা পৈত্রিক সূত্রে মুখের ভাষা পেলেও আমরা কেউই এককভাবে  সে সব সূত্র ধরে ভাষার বাবা দাদা বা অবিভাবক হতে পারি না।আর তা হওয়া কখনো সম্ভবও নয়। বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকেও  কেউ এ ধরনের হাস্যকর দাবি তুলতে পারেন না ।অথচ আজকাল ভাষা সংক্রান্ত গুরুগম্ভির আর তত্বাবধায়ক সব বক্তব্য  মন্তব্য শুনে বা পড়ে মনে হচ্ছে এতদিনে ভাষার শক্ত গোছের কিছু বাপ দাদা বা গার্জেন এমন কি প্রশাসক তৈরি হয়ে গেছেন। এরা আর যাই বলুন ,লিখুন বা করুন না কেন সবকিছুতে এরা ভাষাকে কোথাও বিধবা , কোথাও মাতৃপিতৃহীন , কোথাও বা অনাথ করে দেবার কাজটি করতে পারবেন এমন মনে করে থাকেন । তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজেহাদ ঘোষনার কথা যারা
বলবেন , তাদের আমি এই বলে নিরস্ত করতে চাই যে , ভাষার  আপন শক্তিতে তার প্রতিরোধ করার জন্য  যথেষ্ট ।

ভাষা মানুষের যাবতীয় এবং সমুদয় বিভিন্ন বিচিত্র প্রকাশের মাধ্যম হয়ে কখনো যুদ্ধের , কখনো প্রনয়ের , কখনো রাজগৃহের , কখনো পন্যকুঠিরের ,কখনো মনের , কখনো বনের , কখনো আটপৌরে 
প্রয়োজন মেটার কাজটি করে আসছে। এ আসাটা ব্যক্তিগত কারো নির্দেশে বা উৎকোচে হচ্ছে না। এটা স্বাভাবিক ধারাতেই হয়ে আসছে ।

অনেক সময় ভাষাশিল্পী বা কবি সাহিতিকে ভাষাস্রষ্টা বলে তার সম্মানের আধিক্য ঘটানোর জন্য এক শ‘র মধ্যে এক শ ছয় নম্বর দেয়ার মত ব্যাপারটি করে ফেলি। আসলে কেউ ভাষা স্রষ্টাও নন ভাষার জন্মদাতাও নন। তাদের দিয়ে ভাষা অলংকৃত , সুশোভিত আর চকচকে হতে পারে ।এ কৃতিত্বের কাজটুকু ভাষা শিল্পীর । এর সাথে ভাষাশিল্পীর সবচেয়ে বড় কাজ যেটা সেটা হলো  Ñভাষার সত্যিকার প্রান প্রবাহ আবিষ্কার করা । এ প্রবাহের মদ্যেই ভাষার সত্যিকার মেজাজ বা পরিচয় ধরা পড়ে । শহুরে 
ভাষা নিয়ে যতই বিব্রত বোধ করি না কেন , আসলে ভাষার াকৃত্রিম প্রান প্রবাহ আপন গতিতে বয়ে চলেছে । তাই সজ্জিত ভাষা যতই তার অকৃত্রিম ভাষার সাথে যোগাযোগ নিবিড় করে তুলবে , ততই তার প্রানশক্তি বাড়বে ।

ভাষার এ অকৃত্রিম প্রান প্রবাহ বা মেজাজ সম্পর্কে যাদের জ্ঞান থাকে না বা তাকে এড়িয়ে চলার একটা অহংকার থাকে , তারা আর যাই করুন ভাষার প্রান প্রতিষ্ঠা করতে পারেন না । বিদ্যাসাগরকে গদ্য ভাষা শিল্পীর সর্বাগ্রবর্তী ভূমিকা পালনের জন্য স্বর্নমুকুট দিলেও বায়লা ভাষার সত্যিকার প্রান প্রতিষ্ঠা তাকে দিয়ে হয়নি । এমনকি বঙ্কিম মসাররফ সেই বিদ্যাসাগরের ভূমিকাকে দীর্ঘায়িত করেছেন মাত্র।
বাংলা ভাষার প্রকৃত মেজাজ আবিষ্কারের চর্চা যাদের হাত দিয়ে শুরু হয়েছিলো তাদের মধ্যে প্যারীচাঁদ কালীপ্রসন্ন সিংহ  থেকে বীরবল বা প্রমথ চৌধুরী আছেন। তাদের ভাষা চর্চার মধ্যে ভাষার সে খাঁটি প্রানপ্রবাহ আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে । রবীন্দ্রনাথও পূর্ব তীর ছেড়ে পরবর্তীতে পরের তীরে তরী ভিড়িয়েছেন 
 এ ধারাকে প্রতিরোধ করার মত বোকামি আর কেউ করেননি।
ভাষা রাজদরবারে রানী হয়ে ওঠার চেয়ে সর্ব সাধারন্যে গৃহবধু হয়ে থাকতে বেশি ভালবাসে।
কারন তাতে তার প্রানের উপর অলংকারের অযথা অড়ম্বর আর বাড়তি বোঝা চাপানো হয়না।
যাহোক ,ভাষার প্রকৃত প্রানশক্তি লুকিয়ে থাকে তার শব্দের মধ্যে। তাই ভাষার প্রশ্নে এই শব্দ নিয়ে বিস্তর হৈ চৈ হয়। এ প্রসঙ্গে আমি একটা সংক্ষিপ্ত ধারাবাহিক সমিক্ষায় আসতে চাই । মোটমুটি ভাবে ভারতীয় তথা নব্যভারতীয় আর্য ভাষা থেকে যদি আমরা বাংলা ভাষার পথ পরিক্রমার উৎসসূত্র আবিষ্কার বা চিহ্নিত করতে চাই ,তাহলে পালি প্রাকৃত অপভ্রংশ থেকে আজকের উড়িয়া অসমিয়া বাংলা প্রভৃতি ভাষার মধ্যে এক অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক প্রানপ্রবাহ আবিষ্কার করতে পারবো। যে অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক প্রান প্রবাহ এ সব ভাষা অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে আজো একই। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এ প্রবাহ খাত পরিবর্তন করেছে মাত্র। আর খাত পরিবর্তনের সময় সে সব পরিবর্তনের চিহ্ন স্বরূপ নতুন পোষাক পরিচ্ছদ, নতুন শব্দ নতুন ভাব নানা ভাবে এসে যুক্ত হয়েছে। এ কথার সত্যতা মিলবে যদি উপমহাদেশের সব অঞ্চলের লোকসাহিত্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় আর তার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান তৈরি করে তাদের তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। কারন যে বৃহৎ জনগোষ্ঠির ভাব প্রকাশের গুরু দায়িত্ব ভাষা বহন করে চলে , সে জনগোষ্ঠির মন মেজাজ পারিবারিক ও সামাজিক আচার আচরন চালচলন ব্যবহারকে অস্বীকার না করে ভাষা গ্রহন করে নিয়েছে। 

এটা সম্ভব হয়েছে ভাষার নিজস্ব শক্তির দ্বারা । ভাষার  নিজস্ব শক্তি কোন শাসনের তোয়াক্কা রাখে না। এ শক্তিকে রাজ শাসনে শৃংখলিত করে দরবারে রাজকীয় মর্যাদায় ধরে রাখার  যত চেষ্টাই হোক , কার্যত গনদরবারে এ শক্তির পরিপূর্ন বিকাশ ঘটে। রাজদরবারে তৈরি শব্দ সম্ভার চিরকাল পরিত্যক্ত হয় ভদ্রভাবে।বিদেশী নতুন শব্দ আমদানী করে যেমন কোন ভাষাকে ধ্বংস করা যায় না , তেমনি ভাষার সত্যিকার প্রান প্রবাহকে নি®প্রান করার জন্য সে প্রবাহকে একেবারে থামিয়ে দেয়া যায়না। তবুও এ ধরনের প্রচেষ্টা স্বার্থবাদীরা চিরকাল করে থাকে।
মানুষের বাকযন্ত্র সতত সরল ও সহজ উচ্চারনে বেশি অভ্যস্ত। তাই যে শব্দের উচ্চারন কষ্টকর হয়ে ওঠে তা হয় পরিত্যজ্য , না হয় সরলিকৃত হয়ে ব্যবহৃত হতে থাকে। ইংরেজীর কনষ্টবল ও পুলিশ শব্দ দুটো ইংরেজ আমলে বাংলা ভাষায় প্রচলিত হলে বাকযন্ত্র পুলিশ শব্দটাকেই স্বাগতম জানিয়েছে এবং
ধরে রেখেছে। এমনি করে সেপাহী শব্দটাকে সরল করে সেপাই করে নিয়েছে। আইন জারি করে দিলেও কনষ্টবল শব্দটিকে বাংলাভাষীদের কাছে পুলিশের মত অমন গ্রহনযোগ্য করে তোলা যাবে না। তাই পুলিশের তৈরি করা প্রতিশব্দ আরক্ষা-কে বাংলাতে এ যাবত চালু করা যায়নি।
ভাষার এ নিজস্ব গতি আর প্রানশক্তি না থাকলে পালি আর প্রাকৃত আজো আমাদের মুখের ভাষা থেকে যেতো। অথবা ইন্দোইউরোপিয়াম ভাষা তার যাত্রাপথের প্রথমেই স্থির হয়ে যেতো আজ অবধি।
একটি ভাষা তার স্বকীয় সত্ত¡ায় স্পষ্ট হয়ে ওঠার জন্য দীর্ঘ তার পথপরিক্রমায় নিজ ভান্ডারে অন্য ভাষার শব্দ অলংকার বাক্য গ্রহন করে এবং ব্যবহারে তা নিজস্ব করে নেয়। তারও কিছু অনিবার্য কারন রয়েছে। অনেক গুলো কারনের মধ্যে যে গুলোর প্রাধান্য স্বীকার্য সে সব হলো Ñ রাজনীতিক,ধর্মীয় ও বানিজ্যিক।
 এ সব কারনে এক ভাষার শব্দ অলংকার বাক্য আরেক ভাষায় এসে স্থান করে নেয়।বাংলা ভাষাতেও এ ভাবে বহু বিদেশী শব্দ বাক্য অলংকার প্রবেশ করে এ দেশীয় হয়ে গেছে। হয়ে যাওয়ার ব্যপারে যে সব প্রক্রিয়া আর পদ্ধতি রয়েছে তা রীতিমত ধ্বনিতত্ত¡ ও তুলনামূলক ভাষাতত্বের ব্যাপার। এ পরিসরে তার আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে এতটুকু বলা যাবে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব পদ্ধতিতে তা করে নিয়েছে।

রাজনীতিক ধর্মীয় ও বানিজ্যিক কারনে যে পরিমান বিদেশী শব্দ বাংলা ভাষায় কখনো পরিপূর্ন কখনো আংশিক ভাবে এসে এ দেশীয় হয়ে গেছে এবং অর্থের দিক থেকে কখনো বিস্তৃত কখনো সংকুচিত হয়েছে , তাকে নিজস্ব করে নেবার যে ক্ষমতা সেটা বাংলা ভাষার  তথা যে কোন ভাষার নিজস্ব ক্ষমতা। এ ক্ষমতাকে বলা হয় ভাষার শোষন ক্ষমতা বা গ্রহন ক্ষমতা। এ ক্ষমতা কৃপন নয় বরং উদার।এ ক্ষমতা যে ভাষায় নেই , সে ভাষা মৃত হতে বাধ্য। এ রকম উদাহরন সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট পন্ডিতগনের সৃষ্ট ভাষা সংস্কৃতের ক্ষেত্রে । সংস্কৃত ভাষার সীমাবদ্ধতা এবং গুরুগম্ভির ভারত্ব ভাষার খরতর স্রোতের ধারায় মিলিত হতে  পারেনি। সে জন্য মুখের ভাষা হয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেনি সংস্কৃত ভাষা। 

কোন নদী যেমন বহু জনপদ অতিক্রম কালে অঞ্চল বিশেষের ছোটখাটো খাড়ি নদীনালা খালবিল
প্রভৃতির জলধারাকে নিজের বেগবান ধারায় এক করে নেয় আর তাতে তার প্রান শক্তি বেড়ে যায়, তেমনি  বাংলা ভাষাও পারিপার্শ্বিক অনেক ভাষার শব্দ বাক্য অলংকার গ্রহন করে তার শাব্দিক আর আত্মিক শক্তিকে বাড়িয়ে নিয়েছে অনেক পরিমানে। এ কারনে পর্তুগীজ ডাচ ফরাসী চীনা ইংরেজী আরবী ফারসী শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, এসেছে তাদের অনেক প্রবাদ বাক্যরীতি অলংকার। জনগনের ব্যবহারিক জীবনে যে সব বিদেশী শব্দ প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হয়েছে , সে সব শব্দকে তারা সযতেœ রক্ষা করে চলেছে আজো।
জনগনই ভাষার রক্ষক আর অবিভাবক। ভাষা জনগনের সাথে অপরিহার্যভাবে জড়িত বলে ভাষার মৃত্যুতে জাতির মৃত্যু অবশ্যম্ভাবি হয়ে ওঠে। তাই ভাষাকে রক্ষ করতেই হয়। এ দিক থেকে ভাষার অবিভাবক জনগন। জনগনের প্রবাহমান সবাক জীবন যাত্রার মাঝে যেখানে ভাষা নিজস্ব গতিপথ নিজে সৃষ্টি করে নিতে পারে সেখানে ভাষার শব্দ আর তার মন মেজাজ নিয়ে হৈ চৈ কান্ড বাধাবার দায়িত্ব কোন 
ব্যক্তি বা দল বিশেষের থাকতে পারে না। অথচ যারা চান ভাষা তাদের মনোমত হবে , তাদের কথামত ভাষা শব্দ গ্রহন বর্জন করবে ,তারা যে নিতান্ত অরন্যে রোদন করেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
ফরাসী ইংরেজী আরবী প্রভৃতি ভাষাও তো পারিপার্শ্বিক বহু বিদেশী ভাষার শব্দ গ্রহন করে সাবলিলভাবে নিজের করে ফেলেছে। তাতে তো তার মর্যাদাহানী হয়নি।ভাষার এ হেন মানসিকতার সাথে যাদের সমামান্যতম পরিচয় আছে তার কখনোই বাংলা ভাষায় আগত বিদেশী শব্দ যেমন পর্তুগীজ , ফরাসি ,ইংরেজী ,আরবী ,ফরাসি শব্দ ঝেটিয়ে দূর করার মত অমন হাস্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের কথা বলবেন  
  না।
রবীন্দ্রনাথ এক সময় কাব্যে নজরুল ইসলামের ‘খুন’ শব্দ ব্যবহারে মনক্ষুন্ন হয়ে ঠান্ডা বিরোধের অবতারনা করেছিলেন। নজরুল ইসলামো অনেকটা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। পরে প্রমথ চৌধুরী ব্যাপারটার একটা সুরাহা করতে পেরেছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ অবাংলা শব্দ ব্যবহারের ব্যাপারে  অসহিষ্ণু নির্বোধ
দের আপোষমুখী হতে বলেছেন। তিনি স্মরন করে দিয়েছেন Ñ খোদ হিন্দু শব্দটাও মুছলমানদের দেয়া।
এ নামের ভারতবর্ষ আজো হিন্দুস্থান আর তার ধর্ম হিন্দুধর্ম।খোদ বাংলা নামটাও তো মুছলমানদের সৃষ্টি।
আরবী প্রত্যায়ন্ত এ শব্দ দেখে যারা ক্ষেপে গিয়ে ‘বাংলা’শব্দটাও ঝেটিয়ে দূর করতে চাইবেন তারা তো সরাসরি আত্মহত্যা করে বসবেন। 
এর পরেও কথা থাকে। শুধুমাত্র এক লক্ষ টাকার একখানা নোট ছাপালেই বাজারে সে টাকার ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে , তা ভাবা যাবে ন্ া।এক লক্ষ টাকার নোটটাকে বাজারে চালু রাখতে গেলে সম পরিমানের একশত পাঁচশত  তার সাথে দশ পাঁচ এক টাকার নোট ছাপাতে হবে। এমনকি কিছু খুচরো মুদ্রাও তৈরি করতে হবে। তেমনি কোন ভাষা কোন বস্তু বা বিষয়ের একটি মাত্র শব্দ নিয়ে সম্বৃদ্ধ হতে পারে না। এমন কি চলার গতিবেগ অর্জন করতে পারে না।
ভাষ্যের পরিধি সৌকর্য ওজন দৈর্ঘ প্রস্থ  হ্রস্বত্ব বেধ গুর ুত্ব এক কথায় ভাবের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযোগি করার জন্য একটি বস্তু বা বিষয়ের কিছু সংখ্যক শব্দ থাকা চাই। জীবন্ত ভাষা তাই প্রয়োজন মত প্রতি শব্দ আহরন করে থাকে। যাতে উক্ত প্রয়োজন মেটানোর সাথে সাথে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষনের পথ তৈরি করতে পারে। 
 যে ভাষাতে শব্দের যত বেশি প্রতি শব্দ থাকে সে ভাষা ও তার  শব্দ ভান্ডার তত বেশি ধনী। অথচ বাংলা একটি ধনী ভাষা হওয়া সত্বেও এমন কিছু একক শব্দের অধিকারী , যা আদতে বিদেশী শব্দ। তার বাংলায় কোন যুৎসই প্রতিশব্দ নেই। যেমন আরবী ভাষা থেকে পাওয়া ‘বিদায়’ শব্দটি। বিদায় -এর মত এমন অপরিহার্য শব্দ বাংলায় ছিলো না। প্রাচীন বাংলায় যা ছিলো তা হলো ‘ মেলানি ’। দেহ মেলানি অর্থাৎ বিদায় দাও বলে প্রচীন কাব্যে উলে­খ হয়েছে। বিদায় শব্দটি পাওয়ার পর বাংলা ভাষা অনেক আগে মেলানি-কে ত্যাগ করে এসেছে। এখন বিদায় অর্থে মেলানি-কে কেউ আর মেনে নিতে রাজি হবেন না। ‘বগল’ কথাটা নিয়েও ঐ একই ব্যাপার। ‘কাঁকতলি’ কখাটা থাকা সত্বেও বাংলা ভাষা ‘বগল’ শব্দকে এমন অবাধ ছাড় পত্র দিয়েছে কেন ?আবার আরবী ‘হয়রান’শব্দটা বাংলাতে আধিপত্য বিস্তার করে ভাব ও অর্থের এমন বিস্তৃত পরিমন্ডল সৃষ্টি করেছে যে ,বাংলা প্রতিশব্দ ক্লান্ত শ্রান্ত প্রভৃতি শব্দ দিয়ে তার সম্পূর্ন পরিপূরন করা সম্ভব হয়না ।

তবুও সময় সময় শব্দের জাত বিচিার নিয়ে কাদা ছোঁড়া ছুঁড়ি কম হয়না। পরবর্তীতে এ সব অপকর্ম নিস্ফল হয়ে যায়। জল আর পানি এ প্রসংগে উলে­খের দাবি রাখে। শব্দ দুটোর এক বস্তুবাচক অর্থ হলেও এতে অনেকে হিন্দুয়ানি আর মুছলমানি গন্ধ খুঁজে পান। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো শব্দ দুটোর উৎপত্তি স্থল একই। আবার কোথাও একই স্থানে হিন্দু মুছলমান নির্বিশেষে পানি বা জল ব্যবহার করেন।
  এ প্রসংগে ধর্মচর্চায় ভাষার আর ভাষাচর্চায় ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে কিছু কথা এসে যায়। পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় সব ধর্মাবলম্বী লোক রয়েছে। অথচ ধর্মগ্রন্থ যে কোন একটি ভাষাতে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং তার বহুবিধ ব্যাখ্যা বা তাফছিরও সে ভাষাতে কম বেশি লেখা হয়েছে। যেমন কোন ধর্মগ্রন্থ ও তার ব্যাখ্যা হিব্র“তে , কোন ধর্মগ্রন্থ ও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষন সংস্কৃতে আবার কোন ধর্মগ্রন্থ ও তার ব্যাখ্যা ও তাফছির আরবীতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। একটি দেশের সব ধর্মের লোকেরাই স্ব স্ব ধর্মের কথা মাতৃভাষাতে লিখতে বা বলতে চান। আবার দেখা যায় সবার মাতৃভাষা একটি । যেমন বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান মুছলমান প্রায় সবাই আরবীর পাশাপাশি মাতৃভাষা বাংলাতে ধর্মচর্চা করেন। ভারতীয় হিন্দুদের একাধিক মাতৃভাষা রয়েছে। তারা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষাতে ধর্মচর্চা করেন। এমতাবস্থায় প্রত্যেকের মাতৃভাষাতে ধর্মীয় পরিভাষাসহ অনেক বিদেশী শব্দ প্রবেশ করেছে।বাংলা ভাষাতেও ধর্মীয় পরিভাষাসহ অনেক প্রাচীন ও বিদেশী ভাষা প্রবেশ করেছে এবং রীতিমত এ দেশীয় ভাষা হয়ে গেছে। যেমন  যিশু ,বৌদ্ধ , ঈশ্বর , ব্রহ্ম ,আল­াহ , রাছুল নাবী , ত্রপিটক ,কোরআন ,বাইবেল ,বেদ ,সংহীতা প্রভৃতি এ ধরনের শব্দ।ফিরিস্তি বানালে আরো এ ধরনের অসংখ্য শব্দ বেরিয়ে আসবে।

তাছাড়া প্রত্যেক ধর্মের মানুষের তাদের নিজ ধর্মগ্রন্থের ভাষার প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধ মানসিক দুর্বলতা থাকে। এটা দোষের নয়। দোষের হয় তখনই যখন ধর্মগ্রন্থের ভাষার কাছে নিজের মাতৃভাষাকে  
অত্যন্ত হেয় ভাবা হয় অথবা নিজ ভাষাকে ঘৃনা করা হয়। আসলে ব্যাপারটা নিয়ে কোন বিরোধ ঘৃনা বা 
বিরূপ মনোভাব থাকার কথা নয়।কারন কোন ধর্মগ্রন্থই অন্য ভাষাকে ঘৃনা করতে বা নীচ ভাবতে বলেনি।
 তাই এ কথা বলা যুক্তিযুক্ত এবং প্রয়োজন যে , কোন ধর্মীয় ভাষা কারো মাতৃভাষাকে নাকচ করে দিতে পারে না। এ কথা মেনে নিয়ে এ মনোভাব গ্রহন করতে অসুবিধা নেই যে ধর্মীয় ভাষা মাতৃভাষাকে সম্বৃদ্ধ করে।

রাজনীতি যেমন একটা দেশের জন্য অপরিহার্য তেমনি তা জনজীবনে প্রভাবশালী। তাই ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে সময় বিশেষে রাজনীতি তদারকি ও গার্জেনগিরি ফলাবার সুযোগ পায়। যুগে যুগে বিদেশী শাসকরা অধীনস্থ দেশীয় ভাষার উপর এ ধরনের তদারকি আর প্রভুত্ব করার বাহাদুরি দেখিয়েছে।
রাষ্ট্রভাষা যখন যে ভাষা থাকে সে দেশে (উপনিবেশ হলেও ) সে ভাষা সর্বসাধারনের অনুসরনীয় ও শিক্ষনীয় হয়ে ওঠে। চাকুরি বাকুরি ব্যবসা বানিজ্য এবং মান সম্মান আর আভিজাত্য পদমর্যাদা রক্ষার ক্ষেত্রে এ প্রচেষ্টা অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে মনে হয়। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাথে সাথে এ প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ে
রীতিমত। পরবর্তীতে আবার নতুন করে নতুন বাষ্ট্রভাষার অনুসরন ও অনুশীলন শুরু হয়। মোঘল পাঠান ইংরেজ আর খান আমলে পাক বঙ্গ ভারতে এ ধরনের রাষ্ট্রিয় ভাষা পরিবর্তনের ধারায় আরবী ফারসী উর্দু
ইংরেজী ভাসা চর্চার জোর অনুক’ল স্রোত বহানো হয়েছিলো। 
এ কথা তো সত্য , দেশীয় ভাষাকে উপেক্ষা করে  শাসকরা যখন ইচ্ছামত তাদের নিজ পছন্দের 
ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করে তাদের শাসিত কোন দেশে চাপিয়ে দেয় ,তখন তারা বস্তুত সে দেশের সত্ত¡াকে অস্বীকার করে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এটা অবশ্য প্রয়েজনীয় এবং কৌশলগত দিক। এতে একটা ব্যাপার স্পস্ট হয়ে ওঠে তা হলো Ñ বিদেশী শাসকরা যেমন শাসিত শোষিত দেশের ত্রানকর্তা রক্ষাকারী মালিক বলে নিজেেক ভাবে ,তেমনি ভাষার ক্ষেত্রেও এমন একটা মনোভাব ব্যক্ত করে যে তারা প্রজাকুলের মুখের ভাষারও মালিক। তাই যে কোন আইন করে তা প্রতিষ্ঠিত করার স্পর্ধা দেখায়। কার্যত তা অত্যাচার আর নিপীড়ন হয়ে দেখা দেয়।তাদের শাসন কালের সমাপ্তিতে সে অত্যাচার ও নিপীড়নের অবসান ঘটে।তবে 
কিছু সংখ্যক মোছাহেব বা ক্রীত অনুরক্ত থেকে যায় , যারা দীর্ঘদিন গত প্রভুদের মন মেজাজ অভিরুচি ও 
চলন বলন রফ্ত করে তা নিজেদের জীবনে বা সমাজ জীবনে বজায় রাখার আপ্রান চেষ্টা চালায়।তাইতো ইংরেজী উর্দূর কবল মুক্ত হয়েও বাংলা ভাষা তাদের কাছে সত্যিকার মর্যাদা পাচ্ছে না। কারনে অকারনে বিদশী বুলি আওড়িয়ে তাকে অপমানিত করে চলেছে। 

দেশী শাসকগনও অতিদর্পে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাষা চর্চায় ও শিল্প সাহিত্যে অংশ গ্রহনের মাঝ 
দিয়ে ভাষার উৎকর্ষ অপকর্ষের মালিক সাজার চেষ্টা করেন। যোগ্যতা ছাড়াই ভাষা সম্পর্কে এমন সব উক্তিসহ  এমন কিছু কার্যক্রম গ্রহন করেন যা নিসন্দেহে জোর করে অবিভাবকত্ব ফলানোর সামিল। তবে

ভাষা চেতনা এবং আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা

একটি মানুষ তথা একটি জাতির অস্তিত্বের জন্য যে কয়েকটি জিনিস অপরিহার্য তার মধ্যে ভাষা  প্রধান অন্যতম। অস্তিত্বের যে কোন খুঁটিকে দুর্বল করে বা ধ্বংস করে একটি জাতিকে ধ্বংস করা ও গোলাম বানানো যায়। পক্ষান্তরে অস্তিত্বের আক্রান্ত খুঁটিটাকে কেন্দ্র করে একটি মানুষ বা একটি জাতির স্বাধীন সত্ত¡ার চেতনা উজ্জীবিত হতে পারে।এমন কি সে চেতনা জাতীয় বিপ্লব থেকে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়।
তবে এ কথা সত্য যে অস্তিত্বের অন্যান্য খুঁটি গুলো গৌন বা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে না। 

বাংলা দেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অন্য দেশে যেখানে  বিশ্বাস বা ধর্ম বা ভূমিকে কেন্দ্র করে বিপ্লব ঘটেছিলো সেখানে বাংলাদেশে ভাষা চেতনা থেকে গনজাগরন , তা থেকে স্বাধীকার আন্দোলন , অত:পর মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। 

বহিরাগত কোন শাসক , ধর্মপ্রচারক এবং যে কোন লক্ষ্যে আগত বিদেশীরা প্রথমে যে সমস্যার সম্মুখিন হয় তা হলো দেশের ভাষা। সে কারনে সে ভাষার সাথে প্রয়োজনের খাতিরে পরিচিত হতে হয়।
পরিচিতির প্রয়োজনটা তারা দুভাবে মেটায়। এক ,তারা নিজেরা সে দেশের ভাষা শিক্ষা করে , দুই , দেশীয় পন্ডিত বা শিক্ষিত ব্যক্তিকে কিনে নিয়ে। এতে অবশ্য মনে করার কোন কারন নেই যে , তারা দশটির ভাষা ,সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি বা সুসংস্কার সধন করে। শ্রীরাম পুরের পাদ্রীদের মিশন বা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ সম্পর্কে এ রকম একটা ভ্রান্ত ধারনা প্রচলিত আছে।
এটা অত্যন্ত সত্য যে ,কোন লোক বা গোষ্ঠি পরিকল্পনা করে সচল ও সজীব ভাষা তৈরি বা সৃষ্টি করে দিতে পারে না। কৃত্রিম ভাষা সৃষ্টির যত প্রচেষ্টাই হোক না কেন , ভাষা সব সময় কৃৃত্রিমতা পরিহার করেছে। প্রতিটি ভাষার বহমান একটা গতি আছে। তার জন্মের ব্যাপারটাও প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক। সময় বিশেষে ব্যক্তি বা গোষ্ঠি তাতে গতি বাড়াতে সাহার্য করতে পারে মাত্র।

বিদেশী শাসকরা যে কারনে একটি শাসিত দেশের ভাষা শেখে ,ঠিক সে কারনেই তারা সে দেশের ভাষার সুসংহত বিকাশ আর স্বচেতনা সম্বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করার পথ তৈরি করে। কারনটা হলোÑ তাদের প্রশাসনে যেন বিঘœ উপস্থিত না হয়। তাই ভাষাকে নিয়ন্ত্রন করার সুচতুর অপচেষ্টা যুগে যুগে ইতিহাস হয়ে আছে। দেশ পরাধীন হলে ভাষাও পরাধীন হয়ে যায়।

সুচতুর অপচেষ্টা শুরু হয় দেশীয় সুবিধাবাদী শিক্ষিতদের দ্বারা। সুকৌশলে তাদরে দিয়ে সাহিত্যে দর্শনে শিল্পে সংগীতে ইতিহাসে ্ক কথায় জীবনের সর্বক্ষেত্রেতাদের মনোভাব াার মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটায়।অল্প শিক্ষিত আর অিিক্ষত একটা জাতির জন্য এর চেয়ে বড় আক্রমন ষড়যন্ত্র আর নিপীড়ন কিছু হতে পারে না।

১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে প্রদেশগুলোর স্বায়ত্ব শাসনের যে অংগিকার লিপিবদ্ধ ছিলো , তাকে অস্বীকার  করে  তৎকালীর পূর্ব পাকিস্তানে উর্দূকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রকাশ্য যে অপচেষ্টা শুরু হয়েছিলো তা ছিলো এ দেশের জনগনের অস্তিত্বের উপর সকচেয়ে জঘন্য আগ্রাসন। এ কথা অস্বীকার করার তো আর উপায় নেই যে ,এ দু:সাহস বা ষড়যন্ত্রের মদদ দিয়েছে এ দেশীয় শিক্ষিত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
এ প্রসংগে আমাদের দুর্বলতা ও দোষের কথা অকপটে স্বীকার করতে হবে। আর দশটা বদগুনের মত আমাদের ধামাধরা তোষন নীতির  কথা বরতে হবে। ক্রোদ ও বিরুক্তির কারন যতই হউক ,ইতিহাস তো ক্ষমা করবে না। যুগে যুগে আমাদের ভিক্ষা চাওয়ার  প্রসারিত হাত তার সত্যতা স্বীকার করছে। 

দেশী বিদেশী অত্যাচারী বা হিতৈষী সব শাসককেই তো আমরা বেশির ভাগ শিক্ষিতরা আগু বাড়িয়ে স্বাগতম জানিয়েছি। দেশের আপামর  সাধারন মানুষেরা তাকে অনুসরন করেছে মাত্র। নান্দি পাঠের স্তুতি প্রনয়ন করে কলংকিত হয়ে আছি আমরা।এতে হয়ত ব্যক্তিগত বা বিশেষ সমষ্ঠিগত অনেক ফায়দা এসেছে , কিন্তু জাতীয় স্বার্থে শুধু শূন্য জমেছে।দুচারজন প্রতিবাদী শিক্ষিতরা কোনঠাসা আর অপাংতেয় হয়ে থেকেছে। 
লোভ যেমন ব্যক্তি তথা জাতিকে দাসত্বে নিয়ে যায় ,তেমনি ভিক্ষাও তাকে চাটুকর হতে শেখায়।
প্রতিবাদী হওয়ার চালিকা শক্তি ভিক্ষা কখনোই হতে পারে না। পরিশ্রম না করে ভোগ করার যে সেুখ তাতো ভিক্ষুক হতে প্রলুব্ধ করবেই।আর ভিক্ষা পাওয়ার জন্যই শাসকের কাছে আমাদের এই চাটুকারিতা
তাই বলছিলাম ,আমাদের ভাষা ও জাতীয় সত্ত¡ার প্রতি আক্রমন আর নিপীড়নের দায়দায়িত্ব পরদেশী শাসকদের কৃতকর্মের উপর চাপিয়ে ইতিহাস লিখলে বা সভা জনসভায় একুশের অনুষ্ঠান করলে জাতীয় চেতনার পূর্ন বিকাশ ঘটবে না।কারন উক্ত অপকর্মের ভাগী আমরাও যে ছিলাম এবং এখনো আছি তা স্বীকার করে নিতে হবে। জীবন জীবিকার দোহাই পেড়ে আমরা যারা এড়িয়ে যেতে চাই , তাদরেকেও চিহ্নিত করতে হবে। 
অসংথ্য সাধারন মানুষের  মানসিকতা সৃষ্টিতে যাদের প্রভাব স্বীকৃত মানসিকতা বিশ্লেষন ও পরিবর্তিত করতে হবে। ভাষা সংক্রান্ত মানসিকতা সৃষ্টিতে ধর্ম রাজনীতি অঞ্চলপ্রীতি ব্যবসা বানিজ্য প্রভৃতি বিষয়ক চেতনা কাজ করে।
ধর্মীয় বোধ ভাষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকরি। কারন  ধর্ম গ্রন্থের ভাষার কাছে আর সব ভাষাকে গৌন বা নিকৃষ্ট ভাবার এক উৎকট প্রেরনা করেন ধর্মগুরুরা। বাংলাদেশে বিশেষ করে কোরআনের ভাষা 
আরবী হওয়াতে তার মর্যাদা সর্বাগ্রে। সেজন্য আরবীর প্রধম পাঠ একটা কায়দা বইকেও কোরআনের মত সম্মান দেয়া হয়। আরবী ভাষা শিক্ষাকে সাধারন মানুষের কাছে অবশ্য পাঠ্য করা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থ কোরাান শেখার ও পড়ার জন্য আরবী শিক্ষার প্রয়োজন আছে। তাই বলে আরবী ভাষার পাশে অন্য ভাষাকে অপাংতেয় বা নিকৃষ্ট হতে পারে না। সাধারনভাবে প্রতিটি আরবী হরফ সবার চেয়ে পবিত্র এমন কথা ভাবার কোন কারন থাকতে পারে না। আর সেজন্যই আরবী হরফে লেখা উর্দূ ফারসি ভাষা বাংলার কাছে বেশি মূল্যবান হতে পারে না।
  কোরআন মজিদের ভাষা  আরবী বলে এ ভাষার প্রতি মুছলমানদের একটা স্বাতন্ত্র শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে । ইছলাম ধর্ম চর্চাতে আরবী ভাষার প্রয়োজন আছে। তাই বলে আরবী ভাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হোক এটা কেউ চাইবেন না । আল কোরআনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব আরবী ভাষাতে নয়। আরবী ভাষাতেও লোকে গালিগালাজ করে অশ্লীল কথা বলে অনেক অনৈছলামিক বিনোদন ও সিনেমা রম্য পত্রিকাপ্রকাশিত হয়। আরবী ভাষা ছাড়া অন্য ভাষাতে আল­াহকে ডাকলে শুনবেন না এমন কোন দলিল কোথাও নেই।
সংষ্কার বোধে তড়িত হয়ে যেমন কিছু হিন্দু ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পানি উচ্চারন করেন না তেমনি কিছু মুছলমান দৈনন্দিনসংলাপে জল উচ্চারন করেন না। অথচ শব্দদুটোর উৎপত্তিস্থল একই জায়গায়। এ কথা তো সত্য যে ,বহু খৃষ্টান আরবী ভাষায় কথা বলেন। তেমনি বাংলা ভাষা হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান মুছলমান দের মুখের ভাষা। অথচ রাজনৈতিক কারনে সুচতুর শাসকরা বাংলাকে হিন্দুদের ভাষা চিহ্নিত করার চেষ্টা
অপচেষ্টা চালিয়েছিলো। আবার মুছলমানদের মুখের ভাষাকে বাংলা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন অনেক হিন্দু পন্ডিত। আরো একটা উৎকট মানসিকতা কাজ করেছে  তাহলোÑখাঁটি মুছলমানিত্বের সাথে বাংলা ভাষা চর্চার বিরোধ আছে।
বাংলাদেশে বহু  বিদেশী শাসক রাজত্ব করেছে , বনিক বানিজ্য করেছে। তাদের সুবিধা মত তারা তাদের দেশীয় ভাষাকে এ দেশের রাষ্ট্রভাষা করেছিলো। সে কারনে প্রচুর বিদেশী শব্দ বাংলায় ঢুকে পড়েছে। অনেকের কাছে এটাও অসহনীয় ব্যাপার। তাদের একটা ভ্রান্ত ধারনা রয়েছে যে সংষ্কৃতভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। আসলে বাংলা ভাষাতে বিদেশী শব্দ আসাতে কারো জাত যায়নি , বরং শক্তি বেড়েছে। আর বাংলা ভাষা বাংলা থেকে গেছে। ফারসি আরবী ইংরেজী হয়ে যায়নি। বিদেশ  প্রেম আমাদের বরাবরই কিছুটা অধিক। তারই আতিশর্যে আমরা বাংলা ভাষাকে রোমান আরবী ইংরেজী হরফে লেখার মত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছি।এ করে রাজনীতিক বানিজ্যিক ফায়দা লুটার চেষ্টায় সফল হতে চেয়েছি।
জীবনের সর্ব স্তরে  বাংলা ভাষার ব্যবহার শুরু করলে মুছলমান খৃষ্টান হিন্দু বৌদ্ধ থাকতে অসুবিধা নেই। তেমনি আবার বুদ্ধিজীবি বিজ্ঞানী চিকিৎসক রাজনীতিক ব্যবসায়ী হতে বাধা নেই। ধর্মবিশ্বাস ও অন্যান্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রেও ভাষা বাধা হতে পারে না।
পলাশীর যুদ্ধে সুবে বাংলার জয় পরাজয় শুধু সিরাজের জন্য ছিলো না ,তেমনি বিশ্বাসঘাতকতার দায়দায়িত্ব শুধু মাত্র মিরজাফরেরও ছিলো না। দেশ তো সালাম বরকত আর নুরুল নাজিমের একার নয়। ভালমন্দের দায়দায়িত্ব দুদলের উপর চাপিয়ে ইতিহাস তর্পন করে নিজেদের বীর ভাবলে চলবেনা। কোন 
শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মানে তার মাতৃভাষার বিরুদ্ধে নয়। পৃথিবীর সব ভাষাই কোন না কোন জাতির মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা। তাই আরবী ফারসী উর্দু ইংরেজী প্রভৃতি ভাষার প্রতি বিষুদ্গার করলে আমাদের মাতৃভাষা তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলা পরিশুদ্ধ সম্বৃদ্ধ আর সর্বত্রগামী হয়ে উঠলো এমন ভাবা বাতুলতা মাত্র। আর বাংলার নিত্য নতুন শব্দ সম্ভার সৃষ্টি করে আঞ্চলিক ভাষার প্রচুর প্রভাব ফেললেই আমাদের ভাষা ও জাতীয় সত্ত¡া স্বাধীন হয়ে উঠবে Ñ এ কথা ভাবারও কোন অবকাশ নেই।
তাই আজ জীবনের সর্বত্র বাংলা ভাষার ব্যপক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের ভাষা চেতনা যেমন ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধে সঞ্চারিত ও সঞ্চালিত হয়েছিলো , তেমনি মাতৃভাষার গুরুত্ব জীবনের গভীরে উপলব্ধি করে আমাদের জাতীয় জীবনের অগ্রগতির সোপান তৈরি করতে হবে। আমাদের সকল চেতনা  বিশ্বাস অনুভবও তার উচ্চারন যখন আপন জীবনবোধের শক্ত ভীতে দাঁড় করানো সম্ভব হবে তখনই মাতৃভাষা বাংলার যথার্থ মর্যাদা রক্ষা পাবে। 
এ কথা একান্তভাবে ভাবতে হবে Ñসিরাজ মরে গেলেও মিরজাফর তার পরবর্তী নবাব।মীরমদন মোহনলাল আর্ত্ম উৎসর্গ করলেও বিদেশী তাবেদার দালাল বিশ্বাসঘাতকদের আত্মা আজো আমাদের উপর ভর করে আছে। লাখো শহীদের রক্ত আর মা বোনের রক্তের দোহাই পেড়ে নিজকে লুকালে চলবে না। হয় নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিজেই ধরা দিতে হবে , না হয় যথার্থ বীরের মত সত্যের পক্ষে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে। যেখানে নরম কথার উপদেশ অনুরোধ কোন কাজে আসবে না সেখানে যুদ্ধ ঘোষনা ছাড়া উপায় কি। বিশ্বাসঘাতকতা আর তাবেদারীর বিরুদ্ধে এ ছাড়া অন্য পথ নেই।
৫২’ এর পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে চেহারা ধরা পড়বে তাহলো আমরা 
 বিশ্বাস ঘাতক। কারন একুশ এলে আমরা যারা ফুলের তোড়া একুশের গান সভাসমিতি আলোচনা সভা 
 আর লেখালেখি নিয়ে অস্থির হয়ে উঠি , তারাই ঘরদোরে আসবাবপত্রে আচার আচরনে পুরো দস্তুর বিদেশী।যারা অ  আ বর্নমালার জন্য অঝোরে শোকাশ্র“ বর্ষন করি , তারাই সন্তানদের ইংরেজী অধ্যুষিত স্কুলে বা অনুরূপ বিদ্যায়তনে ভর্তি করাতে পারলে জীবন সার্থক মনে করি। দুস্থ এতিম হতভাগ্য শিশু ও মাতার কথা বলে আমরা যারা নেতা হই ,ক্ষমতা দখল করি তারাই সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াই ; আমরা যারা শোক দিবস একুশ এলে অপিস আদালতে কালো পতাকা তুলি , শোকসভা করি , তারা আজো বাংলায় চিঠিপত্র দলিলদস্তাবেজ লিখতে লজ্জাবোধ করি অথবা লিখতে পারি না।আমরা যারা বাংলা ভাষাভাষী তারাই নিজেদের সাথে  নিজ দেশে অনর্থক অন্য ভাষায় কথা বলে গর্বিত হই ; আমরা যারা প্রভাত ফেরিতে নগ্ন পদে সপরিবারে বা একাকি অংশ নেই  ,তারাই ফিরে এসে ঘরে বসে বিদেশী গানের ডিক্স বাজাই  ,সম্পূর্ন বিদেশী পানিতে অভ্যস্ত হয়ে বিদেশী কায়দায় জীবন গড়ে তুলি , যারা বাইরে এক আর ভেতরে আরেক তারাইতো  বিশ্বাস ঘাতক।
ভাষা আন্দোলন আর একুশের চেতনার কথা বলে , বাংলা ভাষা সৈনিকের দোহাই দিয়ে বাংগালি    য়ানার গৌরব করে আমরা রাজনীতিতে মাঠ গরম করেছি , ব্যক্তিগত বা দলগত ফায়দা লুটেছি তারা কি ব্যক্তিগত  সামাজিক ও রাস্ট্রিয় জীবনে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার রাজনীতি করেছি ?এ কথা তো সত্য আমাদের ছাত্র ছাত্রী আর শিক্ষক কতজন শুদ্ধ বাংলাতে কিছু লিখতে পারে , নিসন্দেহে ভাবনার বিষয়।
আর্থিক সমাজিক নৈতিক রাষ্ট্রিয় উন্নয়ন উৎকর্ষ সাধন করতে গেলে একটি জাতি বা দেশকে অন্য দেশ বা জাতির সাথে সম্পক তৈরি করতে হয়। সে কারনে তাদের ভাষা শেখার হয়ত প্রয়োজন থাকতে পারে। ত্ াবলে নিজের ভাষাকে অবহেলা করে  নয়। ইংলিশ বা অনুরূপ কোন স্কুলে ইংরেজী শেখার জন্য
ব্যবস্থা নেয়া হয়। নিজের ভাষাতে পারদর্শী হলে একটি মানুষের বিদেশী ভাষাতেও পারদর্শী হওয়ার সম্ভবনা বেশি থাকে।কারন নিজের ভাষাতে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা যে অর্জন করে  অন্য ভাষাতে 
 সে নিজকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে। আমরা যখন শিশুকে পরদেশী ভাষা গেরাবার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালাই তখন তা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতারনা ও নিজেদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হয়ে যায়। 

----------------  

                   

Latest posts